ভারতে হিন্দু-আদিবাসী বিবাহ এবং সন্তানের জাতিগত পরিচয় ও কাস্ট সার্টিফিকেট | Caste Identity and Caste Certificates of Hindu-Tribal Marriages and Children in India
১. সংবিধানের ৩৪২ অনুচ্ছেদ
ভারতের সংবিধানের ৩৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারত সরকার একটি তালিকা প্রণয়ন করে, যেখানে প্রতিটি রাজ্যের জন্য আদিবাসী বা তফসিলি উপজাতির (Scheduled Tribes) তালিকা সংরক্ষিত থাকে। এই তালিকা অনুযায়ী সংবিধানের ১৫ ও ১৬ ধারায় তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংরক্ষণের লক্ষ্য হল ঐতিহ্যবাহী ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির উন্নতি নিশ্চিত করা।
৩৪২ অনুচ্ছেদের মূল পয়েন্ট
- কেন্দ্রীয় সরকার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলিকে নির্দিষ্ট রাজ্যের জন্য তালিকাভুক্ত করে।
- এই তালিকা থেকে বাদ পড়া বা নতুন গোষ্ঠী যোগ করার জন্য সংসদের অনুমতি প্রয়োজন হয়।
- কোন আদিবাসী সন্তান তার পিতামাতার তালিকাভুক্ত জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতিগত সুবিধা পেতে পারে, তবে শর্ত হল তাকে সমাজের দ্বারা গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
২. সুপ্রিম কোর্টের রায়: V. V. Giri v. D. S. Raju, ১৯৯৪
এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে যে, যদি একজন তফসিলি জাতি বা তফসিলি উপজাতির সদস্য কোনো সাধারণ জাতির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাদের সন্তানদের পরিচয় নির্ধারণ করতে হবে সন্তানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আদিবাসী জীবনযাপনের ভিত্তিতে। আদালত ব্যাখ্যা করে, শুধুমাত্র আদিবাসী রক্ত থাকা যথেষ্ট নয়; সন্তানের আদিবাসী সমাজের সাথে সংযুক্তি, সংস্কৃতি অনুসরণ এবং সমাজের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হতে হবে।
৩. জাতিগত শংসাপত্র সংক্রান্ত নীতিমালা
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের জাতিগত শংসাপত্র প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে, যার লক্ষ্য হলো কাস্ট সার্টিফিকেট প্রদান প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। জাতিগত শংসাপত্র পেতে সন্তানের পিতা বা মাতার আদিবাসী পরিচয় থাকা ছাড়াও বেশ কিছু শর্ত থাকে, যেমন:
- সন্তানের আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা।
- সন্তানের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতির মধ্যে আদিবাসী ঐতিহ্য ও ধর্মের উপস্থিতি।
- সন্তানের পিতা বা মাতা যদি আদিবাসী হন এবং সন্তান যদি আদিবাসী গোষ্ঠীর সমাজের অনুমোদন পায়, তবেই জাতিগত শংসাপত্র প্রদান সম্ভব।
৪. সংবিধানের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ধারা
১৫ অনুচ্ছেদ: বৈষম্য নিষেধাজ্ঞা
১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য করা যাবে না। যদিও এই ধারা থেকে তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের সংরক্ষণ প্রদান করার জন্য ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
১৬ অনুচ্ছেদ: সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ
১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের সুযোগও রাখা হয়েছে, যাতে তারা সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
৫. জাতিগত শংসাপত্র সংক্রান্ত বিতর্ক
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জাতিগত শংসাপত্র প্রদান নিয়ে বিতর্ক আছে। কিছু ক্ষেত্রে, পিতা বা মাতা আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত হলে, সন্তানের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতিগত শংসাপত্র পাওয়া সম্ভব। তবে প্রমাণস্বরূপ সন্তানের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং জীবনধারার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
৬. আইনগত সমালোচনা
এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয়ে সমালোচনা করেছেন:
- প্রশাসনিক নিয়মাবলীর কারণে প্রকৃত আদিবাসী সন্তানেরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
- কাস্ট সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্মকর্তাদের উপর অধিক নির্ভরশীলতা থাকে।
- সাংস্কৃতিকভাবে আদিবাসী পরিচয় থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পিতামাতার পরিচয়ের ভিত্তিতে সুবিধা পেতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
৭. সারসংক্ষেপ
ভারতে হিন্দু-আদিবাসী বিবাহের পর তাদের সন্তানদের জাতিগত পরিচয় এবং কাস্ট সার্টিফিকেট প্রাপ্তি একটি সংবেদনশীল বিষয়। জাতীয় আইন ও সংবিধানের বিভিন্ন ধারা এবং সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় অনুসারে, সন্তানের আদিবাসী পরিচয় নির্ধারণে সমাজের অনুমোদন এবং আদিবাসী জীবনধারা অনুসরণের গুরুত্ব রয়েছে। তবে এই নীতির বাস্তবায়ন প্রায়ই প্রশাসনিক জটিলতা এবং স্থানীয় সামাজিক মতামতের উপর নির্ভরশীল।
উপসংহার
ভারতে হিন্দু-আদিবাসী বিবাহের পর সন্তানের জাতিগত পরিচয় এবং কাস্ট সার্টিফিকেট প্রাপ্তি একটি জটিল এবং সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। সাংবিধানিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তবে বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
0 Comments