মহাকবি সাধু রামচাঁদ মুরমু জীবনী সংগ্রহে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য || Sadhu Ram Chand Aa Jiwon Kahani ||

আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে সাধু রামচাঁদ মুরমুর পরিচিতি “কবিগুরু বা মহাকবি” হিসেবে। সাধু রামচাঁদ মুরমু আদতে সাধু ছিলেন না কিন্তু, সাধুর মতন ভোগ বিলাসহীন সাধারণ জীবন যাপনের জন্য সাধু হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হন। সাধু রামচাঁদ মুরমুর জন্ম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার শিলদার নিকটবর্তী কামারবাঁদি গ্রামে বাংলা ১৩০৪ সালের বৈশাখ মাসের ১৬ তারিখে (ইংরেজি তারিখে ১ লা মে ১৮৯৭)। পিতার নাম মোহন মুরমু ও মাতার নাম কুনি মুরমু। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ভাই দুবরাজ মুরমু, মেজ ভাই ধনঞ্জয় মুরমু, সেজটি বোন, নাম মুগলি এবং সবার ছোট হলেন কবি সাধুরামচাঁদ মুরমু। সাধু রামচাঁদ মুরমু গ্রামের ইস্কুল ও মধ্য ইংরাজী স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা। অভাবের তাড়নায় উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ না পেলেও তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হবার তাঁর অসাধারন ক্ষমতা ছিল। কবি তাঁর ধারাল কলমের শক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সাঁওতাল সমাজ, রীতিনীতি ও সমাজের ভাল মন্দ। শুধু ফুটিয়ে তোলায় নয়, নিখুঁত বুনন, ছন্দ, তাল সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন। তাঁর জন্মের শত বছর পরেও তিনি যা ভেবে ছিলেন, উনি যে ভাবে লিখেছিলেন আজকের দিনেও কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারেন নি। তাই তো মহাকবি। আজও প্রাসঙ্গিক তাই। সাধু রামচাঁদ মুরমু কৈশোর ছাড়াইয়া যৌবনে পা দিয়া দেখলেন যে সাঁওতালরা আদিবাসী হিসেবে ঘৃণিত ও অবহেলিত। সাঁওতালরা নিজ ভাষাকে যথেষ্ঠ পরিমাণ অবহেলা করে। এমন কি পথে ঘাটে দুই জন সাঁওতাল নিজ ভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। সেই জন্য প্রথমত তিনি চাইলেন সাঁওতালদের মধ্যে স্বজাতের অভিমান ও ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করতে। আবার সমস্ত আদিবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অখন্ড পরিমন্ডল তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন।
সাঁওতালি ভাষায় বই ছাপানো তখনকার দিনে একটি অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। তাই তিনি গান রচনা করে সেই গানে নিজে সুর দিলেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গান “দেবোন তিগোন আদিবাসী বীর”- আজ ছোটনাগপুরী ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের জাতীয় সঙ্গীত। কবি সারদা প্রসাদ কিস্কু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সাধু রামচাঁদের গানের ঢেউ পুরুলিয়ার পাহাড়ি বনে আছড়িয়ে পড়লে কৈশোরে তিনিও তরঙ্গায়িত হন। “রামচাঁদ মুরমু আঃ দেবোন তেঁগোন আদিবাসী বীর, অনা তেড়ং হড়কো দুসৗউবোনা সেরেঞ দ নডেন হড়াঃ লুতুররে তারকোগৎ আকানা। সাঁও সাঁওতে উনিয়াঃ সারি ধরম সেরেঞ্ পুঁথিহঁ সেটের এনা।”(সাহিত্য আন্দোড়রে পুরুলিয়ৗ জিলৗ রেন হড় হপন)। ঐ সময় সাঁওতালরা খুব বেশি পরিমাণ ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। বিশেষতঃ খৃস্টান ধর্মে। তিনি সারি ধরম পুঁথি রচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের নিজেদের প্রকৃত ধর্মের বিষয়ে সচেতন করলেন। তবে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি সারি ধরম প্রচার করতে লাগলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে সারি ধরম প্রচার ও আদিবাসীদের সচেতন করতে লাগলেন। তাঁর সাধারণ জীবন যাপন ও সারি ধরম নিয়ে প্রচারের কারণে সাধু নামে অবিহিত হন। ফলে ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁর বহু শিষ্য জুটে গেল। ১৯২৫-৩০ এর মধ্যে সাঁওতালি ভাষার উপযোগী “মজ দাঁদের আঁক” নামে এক বর্ণমালাও তৈরি করলেন। পরবর্তী কালে সেই বর্নমালতেই তাঁর সাহিত্য সম্ভার রচনা করেন। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখাতেই তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাঁর রচিত ‘সংসার ফেঁদ’ খুব উঁচু মানের নাটক। ‘লিটা গডেত’, ‘সারি ধরম সেরেঞ্ পুঁথি’ ‘ইসরড়’প্রভৃতি রচনা বাঙলা লিপিতেই ছাপা। এখনও তাঁর রচনার বিশাল অংশ অপ্রকাশিত। উনিশ শতকের প্রথম প্রহরে যখন সাঁওতালি ভাষায় লিখিত সাহিত্য ছিল না বললেই হয় তখন সাধু রামচাঁদ নতুন নতুন কবিতা ও গান লিখে ক্ষয়িষ্ণু সাঁওতাল সমাজকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। নিজেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিবার লক্ষ্য সাধু রামচাঁদের ছিল না, বরং সাঁওতালি ভাষাকে প্রতিষ্ঠাপূর্বক সাঁওতাল জাতিকে সংঘবদ্ধ করার সংকল্পই ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। সাধু রামচাঁদের এই ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজকের দিনের সাঁওতাল কবি ও সাহিত্যিকরা উপলিব্ধি করেন। সাধু রামচাঁদকে নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ অসংখ্য সাহিত্যিক রচনা করেছেন। তবে বস্তুবাদী সাহিত্যিক ও পোন্ডগোডা পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত গোমস্তাপ্রসাদ সরেনের সাধু রামচাঁদ বিষয়ক কবিতাটিতে যর্থাথ মূল্যায়ণ দেখা যায়। প্রথম কারাম পূজার প্রবর্তক ধার্মুর সঙ্গে তিনি সাধু রামচাঁদের তুলনা করেছেন। সাধু রাম চাঁদ মুরমুও ধার্মুর মতো সকলের বিদ্রুপ সহ্য করেছিলেন।
সাধু রামচাঁদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে ১৯৩৫-৩৬ এর কাছাকাছি। এক কথায় ১৯৩০-৩৯ সাল ছিল সাঁওতাল সমাজের ত্রিবেণী সঙ্গমের যুগ। ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন ও স্বজাতি প্রীতির প্রবল আকর্ষণ, আদর্শবোধ, আদিবাসী মহাসভার দ্বার আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ আবার সাধু রামচাঁদ, পাউল জুঝৗর সরেন, পন্ডিত রঘুনাথ, মুরমু মঙ্গল সরেন প্রভৃতির সাহিত্যসৃষ্টির ভূমিকা একত্রিত হয়ে একটি ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে। সাধু রামচাঁদ বুঝতে পেরেছিলেন, ভাষা ও সাহিত্য ছাড়া কোন জাতির বিকাশ অসম্ভব। সাহিত্যের বিকাশে জাতির বিকাশ তাই বাড়িঘর আত্ময় পরিজন ছেড়ে আমরণ সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। সাঁওতালি সাহিত্যের ধারাবাহিকতাকে বুঝতে সাধুরামচাঁদের রচনার মূল্যায়ন প্রয়োজন। ধর্ম ভাবনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ‘সারি ধরম’- এর প্রবক্তা। তিনিই সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য সাঁওতালি ভাষার স্বতন্ত্র লিপি ‘মঁজ দাঁদের আঁক’তৈরি করেছিলেন ১৯২৩ সালে। এই লিপি বা বর্ণমালা সাঁওতালি ভাষার উপযোগী হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই বর্ণমালাতেই তাঁর সাহিত্য সম্ভার রচনা করেন। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর এই লিপির ব্লক তৈরী করে প্রচার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। জীবিতকালে তিনি তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে আর্থিক অনটনের জন্য মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাই দীর্ঘদিন তাঁর পাণ্ডুলিপি অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই নামাঙ্কিত সাধুরামচাঁদ উইহার বাথান (সাধুরামচাঁদ মুরমু স্মৃতি কমিটি) ও মারাংবুরু প্রেসের কর্ণধার ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের যৌথ প্রচেষ্টায় তাঁর পাণ্ডুলিপিকে সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থগুলি হলঃ-১) সারি ধরম সেরেঞ পুঁথি। ২) অল দহ অনড়হে। ৩) লিটা গোডেৎ। ৪) সংসার ফেঁদ। ৫) ঈশরড়।
কামার বান্দি সাধুরাম চাঁদ মুরমু উইহার বাথান থেকে তাঁর অনেক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। সেই গুলোই পরবর্তী কালে পশ্চিম বঙ্গ সরকাররের পক্ষ থেকে সাধুরাম চাঁদ মুরমু অনল মালা নামে সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর অগনিত পান্ডুলিপি বন্ধু বান্ধব, হিতাকাঙ্খী সেজে প্রকাশের জন্য কবির কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। তারপর সেই গুলোর হুদিস পাওয়া যায় নি। পাওয়া গেলে মাহা কবি ধারতি কবি হতে পারতেন। সাধুরাম চাঁদ মুরমু শুধু কবি ছিলেন না। সাধুও না। তিনি দার্শনিক । তিনি ছিলেন গবেষক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা জাতি ভাষা না হলে বাঁচতে পারে না। আর ঐ ভাষা লিখে প্রকাশ করার জন্য নিজস্য লিপি প্রয়োজন। তাই তিনি অনেক ভাবনা চিন্তা করে- "মঞ্জ দান্দের আঁক" নামক লিপি তৈরী করে ছিলেন। এই লিপি বা বর্ণ বা বর্ণমালা সাঁওতালি ভাষা র উপযোগী হয়েছিল। পরবর্তী কালে সেই বর্ণমালাতেই তাঁর সাহিত্য সম্ভার রচনা করে যান। কবি কোলকাতায় আবস্থিত "ভারতীয় সংগ্রহ শালার মহেঞ্জোদাড়োর লিপি পড়তে পেরে ছিলেন। মহা কবির আবির্ভাব না হলে সাঁওতাল জাতি হয়ত হারাতো তাঁর ভাষা, সংস্কৃতি, তাঁর অস্তিত্ব, সত্ত্বা। তার প্রবনতা ছিল। সম্ভাবনা ছিল। প্রবনতা সম্ভাবনা প্রতিরোধের অধিকারী অবশ্যই মহাকবি সাধু রামচাঁদ মুরমু। অন্য কাউকে সাঁওতাল সমাজ জানতে হলে সাধু রামচাঁদ মুরমু কে জানতে হবে। সাঁওতাল সমাজে বাঁচতে হলে অবশ্যই সাধু রামচাঁদ মুরমু প্রদর্শিত পথ অনুসরন করতে হবে। মান্যতা দিতে হবে। তাঁর অনেক সৃষ্টি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। কবি, সাধু-দার্শনিক, শিল্পী, প্রকৃতি প্রেমিক, সমাজ সেবক, সংস্কারক ও গবেষক সাধুরামচাঁদ মুরমু বাংলা ১৩৬০ বঙ্গাব্দের ১৯ শে অগ্রহায়ন দেহত্যাগ করেন। ইংরাজী সাল ছিল ১৯৫৪ সাল।

Post a Comment

3 Comments

  1. এটা খুবই দুঃখের কথা যে স্বজাতির কিছু অশিক্ষিত মানুষ কবীর পান্ডুলিপি চুরি করে তারা নিজেদের সাহিত্যসৃৃৃৃষ্টি বলে সেগুলো চালানোর চেষ্টা করছেন ৷ গবেষনা করে দেখা গেছে মজ দান্দের আঁক থেকে অনেক সুন্দর একটি লিপি গঠন করা যায় ৷ কিন্তু সার্থপর স্বজাতিয় মানুষেরা সেগুলোকে নিজেদের বলে চালানোর ধান্ধা করেন ৷ তো এই জাতির উন্নতি সম্ভব ??? এরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারে !

    ReplyDelete
  2. ভালো লিখেছেন।আরো তথ্য দিলে ভালো হতো । অনেক কিছু জানতে পারলাম ।আরো বেশি জানতে কৌতুহল হচ্ছে ।আডি সারহাও ।

    ReplyDelete