ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভাষা-ভাষীর মধ্যে একটি অন্যতম জাতি সাঁওতাল। হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে নরগোষ্ঠী এক বিশাল অংশ ধীরে ধীরে অন্যান্য মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। যাদের কে বিজ্ঞানীরা প্রোটো-অস্ত্রলয়েদ নামে চিহ্নিত করেছিলেন। প্রোটো-অস্ত্রলয়েদ মানব হিসাবে মুণ্ডা ও সাঁওতালদের সাথে বিশেষ নৃতাত্ত্বিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এদের ভাষার নাম সাঁওতাল। যে কোন জাতি বা ভাষার মতোই এই সাঁওতাল সমাজের মধ্যেও ঐতিহ্যশালী সাহিত্যের দর্শন পাওয়া যায়। গল্প, কাহিনী ছাড়াও তাদের সুস্পষ্ট সামাজিক চিন্তা, ধর্মীয় ভাবনা ও সাংস্কৃতিক চিন্তা ভাবনা আছে, যা মৌখিক সাহিত্যে তার প্রমান। এই সম্প্রদায় ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশ্যা, আসাম রাজ্যে কোথাও বিচ্ছিন্ন ভাবে, কোথাও বিশাল অঞ্চল জুড়ে আদিবাসী সাঁওতালদের বাসস্থান।এমনকি ভারত বাইরে নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশও ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে এমন মানুষ জাপান, রুশ, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, আমেরিকা দেশেও। জন সংখ্যার নিরিখে ভারত বর্ষে সাঁওতালী ভাষার স্থান ত্রয়োদশ।
ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রাচীন এবং তার ইতিহাস ও অনেক দীর্ঘ।এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিদেশি মানুষের সমাগম ঘটেছে। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি খুব কম হলেও চারতি মৌলিক ভাষা গোষ্ঠী মানুষের সমবায়ে গঠিত। পরিমল হেম্ব্রম এর ভাষায় – “ভাষা বিজ্ঞানীদের মতানুযায়ী ভাশাগুলি চারটি ভাষা গোষ্ঠী থেকে এসছে। এগুলি হল ভোটচীনিয়, দ্রাবিড়ীয়,ইন্দ-ইউরোপিয় এবংঅস্ত্রো-এশিয়াটিক।”1 ভারতবর্ষের প্রকৃত আদিম আদিবাসী কারা তা নিয়ে নৃতত্ত্ববিদরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে। তাদের মতে বর্তমান ভারতে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠী মানুষ প্রত্যেকই বহিরাগত।তবু প্রগৌতিহাসিক যুগে ভারত ভুমিতে আসা মানব গোষ্ঠীর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব কোন না কোন ভাবে তিকে আছে তাঁদেরই আমরা ভারতের আদিম অধিবাসি বা আদিবাসী হিসাবে পরিচিত।
এই ভারত ভূমিতে এসছে মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে সব থেকে যার অস্তিত্ব বহু প্রাচীন তার জন্য গবেষকরা গবেশনা করেগেছেন। তাদের মধ্যে একজন অন্যতম Cavalli-Sforza ও তার সহকর্মী (his co-worker ) ভারত বর্ষের ১০১ জনের মধ্যে Mitochondrial DNA examine করেছে। তার লেখা ‘Peopling of India’ তে পাই –“ The likely major migrations include (i) Austric language speakers soon after 65,000 ybp, probably from northeast (ii) Dravidian speakers around 6,000 ybp from Mideast with the knowledge of cultivation of crops like wheat and domestication of animals like cattle, sheep, goats (iii) Indo-Eropean speakers in several waves after 4,000 ybp with control over horses and iron technology (iv) Sino-tibetan speakers in several waves after 6,000 ybp with knowledge of rice cultivation.”2
ঐ প্রসঙ্গে কৃষ্ণ চন্দ্র টুডু এর উক্তি–“আগ্নেয় ভাষাই গ্রুপ কে লোক যথা – সান্থালি, মুণ্ডারি, হো, খাড়িয়া আদি আজ সে লগভগ ৬০০০০ বর্ষ পেহেলে সে ভারত মেঁ রহ হেঁ। কালক্রমে দ্রাবিড় ভাষা পরিবার, আরজ ভাষা পরিবাররাঁঅ তিব্বতি চিনি ভাষা পরিবার ভারত মেঁ প্রবেশ কিয়া।”3 সরস্বতী গাগরাই এর লিখনিতে আমরা পাই –“আদিবাসী সিরপ ঝাড়খণ্ড প্রদেশ কে আদি নিবাসী হি নহিঁ বল্কি ভারত বর্ষ কি ভূমি পর কদম রাখনে বালে প্রথম লোক হেঁ। ইস্কা জানকারি লোগো কি জিনোম বিবিধতা পরিয়োজনা (জেংডিপ) কি খোজ সে মিলী হেঁ। ইস খোজ কে অনুসার হো, মুনডা, সান্থাল আদি জনজাতি হেঁ। ইন হেঁ অস্ত্রো-এসিয়াটিক ভাষাভাষী গ্রুপ কে অন্তর্গত রখাগায়া হেঁ। খোঁজ কে অনুসার ইয়ে লোগ আজ সে লগভগ ৬০০০০ বর্ষ পূর্ব আফ্রিকা সে ভারত আয়ে থে।“4
প্রগৌতিহাসিক যুগে ভারত ভুমিতে আসা মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক Nityananda Hembram তার লেখা ‘Austric Civilization of India’ তে পাই – “Aryans comes to India in around 2500 B. C. to 2000. B.C. and the Haropan culture flourished somewhere in 3500 B.C. to 2000 B.C.” 5 এই উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে ৬৫ হাজার বছর আগে অস্ত্রিক গোষ্ঠীরা ভারত বর্ষে প্রবেশ করেছিল। এই অস্ত্রিক গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠী একই সঙ্গে বসবাস করছিল। কোন কারন বশত আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যাই। এই অস্ত্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে আসছে সাঁওতালী, মুণ্ডারি, হো, ভুমিজ, বিরহড়, কোডা, অসুর, তুরি, শবর, মাহলি, খাড়িয়া ইত্যাদি।এই অস্ত্রো-এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্যতম সর্ব বৃহৎ জাতি সাঁওতাল। সাঁওতালরা নিজেদের ‘হড়’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে G.A. Greierson এর লেখা Linguistic Survey of India পুস্তক এ পাই - “Santals Call themselves hor-ko, men, or hor hapam, man child. When asked about their name and cast they usully apply the title Manjhi, headman, to themselves. Their language has theirfore sometimes been reported under various name such as har, Har rar, i.e. the speech of the hars, Manjhi, and so forth.”6
ভাষা বিজ্ঞানী সাঁওতালী ভাষা কে দীর্ঘদিন তাদের গবেষণার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে তাদের কে নামকরন গেছেন। ভারত বর্ষে ব্রিটিশ থাকাকালীন প্রাচিন যুগে তাদের কে ‘হড়’ (human) বলে চিহ্নিত করেছেন। মধ্যযুগে সাঁওতাল সম্প্রদায় কে ‘খেরওয়াড়ী’ নামে চিহ্নিত করা হয়। ঐ প্রসঙ্গে G.A. Greierson এর উক্তি তে পাই - “According to Santali Traditions, the tribe was once united with what are now the Mundaris, the Hos, and other small tribes. They assert that in those old times they were called Kherwal or Kharwars.”7 ও আধুনিক যুগে আজ অবদি তারা সাঁওতাল ( সান্তাড়, সান্তাল ) নামে চিহ্নিত। আধুনিক যুগে তাদের সাঁওতাল নামে পরিচিত লাভ করে। L.O.Skrefsrud সাহেবের লেখনি তে পাই – “শিকার পেরিয়ে সাঁত দেশে তারা বহুদিন থাকার ফলে সান্তাল নামকরন করা হয়।“ 8 ঐ প্রসঙ্গে ডঃ ধানেশ্বর মাঝি বলেন – “1795 ই. কে আস-পাস জব সাঁতভূম মেঁ সান্তাল ( হড় ) লোগোঁ টা নিবাস স্থান থা, উসি সময় সে উনকা নাম সান্তাল পড় গয়া।”9 সাঁওতাল নামকরন নিয়ে বাবুলাল মুরমু ‘আদিবাসী’ এর উক্তি – “সান্তাড় শব্দের উৎপ্ততি ‘সাঁত হড়’ থেকে হয়েছে।“10 আধুনিক এই যুগে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায় এখন সাঁওতাল (সান্তাড়, সান্তাল) নামে পরিচিত।
ডঃ সুহৃদকুমার ভৌমিক মতানুযায়ী –“ ‘সাঁওতাল’ এই শব্দের মধ্যে সাঁওতালদের বিশেষ কোন গৌরব নেই।তাদের জাতি-বাচক পবিত্র ও পৌরানিক নাম খেরওাল। প্রাচীন কোলগোষ্ঠীর ভাষায় ‘খের’ শব্দের অর্থ পাখি। খেরওয়াল অর্থাৎ পাখির বংশধর এই জন্য মাঝি রামদাস, সাঁওতাল জাতির ধর্ম পুস্তকের নাম দিয়েছিলেন, ‘খেরওয়াল বংশঃক ধরম পুথি’ এ ছাড়া সাঁওতালদের জাতি বাচক নাম হল-‘হড়’। ‘হড়-সমাজ’ অর্থাৎ সাঁওতাল সমাজ।”11
সমাজ কাঠামো ঃ আদিবাসী ‘সাঁওতাল সমাজ’ অতি প্রাচীন। সাঁওতাল সমাজ একটি সুপরিকল্পিত, উন্নত শাসন ব্যবস্থা আছে. আর তার জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও ক্ষমতা গ্রামের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত বিভিন্ন পদাধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে হলেন – মাঝি, পারানিক, জগ-মাঝি, গোডেত ও নায়কে। ঐ প্রসঙ্গে Charulal mukharjee এর উক্তি – “ Social authority in village is exercised by the headman, but always in consultation with the ‘mare hor’(panchaet) who were originally five in member.”12 এই পাঁচ জন পদাধিকারী ব্যাক্তি দ্বারা সাঁওতাল সমাজ পরিচালিত হয়। এই মড়ে হড় (পাঁচ জন) পদাধিকারী ব্যাক্তি ছাড়া সমাজের কোন কাজ সম্পন্ন হয় না। তাদের কাজ কর্ম হল -
মাঝি – গ্রামের সর্বময় কর্তা বা গ্রাম প্রধান।বলা যাই জন্ম-মৃত্যুতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণে মাঝির নির্দেশ ছাড়া কিছু হয়না। গ্রামের সবরকম দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত থাকে।পারানিক – মাঝির সহকারি।গ্রামে মাঝি অনুপস্থিত থাকলে গ্রাম শাসনের দায়িত্ব পারানিকের উপর। মাঝি যদি এই পদে ইস্তপা দেন বা মারা যান এবং তার যদি কোন ভাই বা বংশধর না থাকে, তবে পারানিকই মাঝির পদ পান।
জগ-মাঝি – গ্রামের যুবক-যুবতীদের কাজকর্মও নৈতিক চরিত্র লক্ষ্য করার দায়িত্বে থাকে।গ্রামে অবৈধ প্রনয়নঘটিত কোন নিন্দানীয় ব্যাপার যাতে না ঘটে তার দায়িত্বে থাকে।
গোডেত – মাঝির বার্তাবহ। যে কোন গ্রামের সভার আয়োজন হলে গোডেত মাঝির হয়ে দিন তারিখ প্রত্যেকের কাছে পৌচ্ছে দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন।
নায়কে - গ্রামের পুজারি।গ্রামের জাহের থান ও সমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠান এ পূজা করেন।এ ছাড়া তার সহকারী হিসাবে কুডাম নায়কে থাকেন।
যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য যে বিচার সভা অনুষ্ঠিত হয় তার আগে একটি কথা বলা হত – “আব দ সেংগেল আতে দ বিচার বাফবন দুড়ুপ আকানা, লটা দাঃ আতে বন দুড়ুপ আকানা।“ অর্থাৎ আমরা আগুন নিয়ে বিচার করতে বসেনি, লটা দাঃ (পবিত্র শান্তি জল) নিয়ে বাসেছি। বিচার সভা তে গ্রামের সবাই যোগ দিত। সবাই একমত হলে সেই মত কে মেনে নেওয়া হত। যতক্ষণ না সকলে একমত হয় ততক্ষণ আলোচনা চলত। কখনও বা ঐ আলোচনা দু-তিন দিন ধরে চলত। সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সভার রায় বলে ঘোষণা করত। তাছাড়া ঐ সভাতে সবারই কথা বলার অধিকার থাকে।
সংস্কৃতি ও রীতিনীতি : সংস্কৃতি একটা জাতির পরিচয়। সংস্কৃতির মাধ্যমেই তাদের সমজের রীতি নীতি কথা জানতে পারি। সংস্কৃতি একটা জাতির পরিচয়ের বাহক। তাই দেখা যাই তাদের ধরম ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে নানা দিক ফুটে উঠে। তার মধ্যে অন্যতম –
1. জন্ম সংস্কার,
2. বিবাহ সংস্কার ও
3. মৃত্যু সংস্কার।
সামাজিক প্রক্রিয়া হিসাবে অত্যাবশ্যক। এছাড়াও তাদের বিনতি কথা ( জমসিম বিনতি, কারাম বিনতি, ছাটয়ার বিনতি, ভাঁডান বিনতি ইত্যাদি), দেব-দেবীর পূজার্চনা ও লোক সঙ্গীতের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে। যেমন – মাগসিম, হারিয়াড় সিম, বাহা, সহরায়, দাঁসায়, কারাম, ডাহার, দং, লাংড়ে, পাতা ইত্যাদি। উৎসব ও পূজা পার্বণ গুলি সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হল -
সাঁওতালদের মধ্যে যেসব পূজা ও উৎসব পালন হয় সেগুলি হল –
1. মাগ সিম - মাগ সিম (মাঘ মাস) এই পূজার দিন গ্রাম পরিচালকদের নির্বাচিত করা হয়।
2. এরঃ সিম - এরঃ সিম (আসাড় মাস) শস্য বোনার প্রাক্কালে করা হয় যাতে শস্য বীজ সুন্দর ভাবে অঙ্কুর হয়ে উঠে।
3. হারিয়াড় সিম - হারিয়াড় সিম(শ্রাবন-ভাদ্র মাস) বোন শস্য সবুজ হলে এবং উপযুক্ত বর্ষণের জল পায়, পোকয়া মাকড়ের কোন উপদ্রব না হয়।
4. জান্থাড় - জান্থাড়(অগ্রায়ন মাস)যখন কোন গ্রাম পত্তন করা হয়। তাছাড়া নতুন শস্য শ্যামল এ বাড়ীর ব্যাবহারের জন্য উপযোগী হয়ে তোলে।
5. বাহা্ - বাহা্ (ফাল্গুন মাস) বিশেষ করে সাল, মহুয়া এবং অন্যান্য ফল-মুল, পাতা আহরন প্রাক্কালে দেবতাদের উৎসর্গ করা হয়। তার পরবর্তী সময়ে মানব জাতি ঐ সমস্ত দ্রব্য ব্যাবহার করে থাকে।
6. সহরায় – সহরায় (কার্ত্তিক মাস) এই উৎসব মানুষের জন্য নয়, গৃহপালিত গুরু-মহিষও এই উৎসবের শরিক। তার সাথে সাথে গৃহ দেবতাদের সেবা করে থাকে।
7. দাঁশায় – দাঁশায় (আশ্বিন মাস) এই উৎসবের উৎস পৌরানিক কথা জানতে পারি যে
এক – এক সময় সাঁওতালদের সবচেয়ে আধিক গুন সম্পন্ন দেবতা ঠাকুর মানব জাতির প্রতি ক্ষোভ ও রাগ-আক্রশ হওয়ার ফলে মানব জাতি কে ধ্বংস করার চিন্তা ভাবনা করেছিলেন, মানব জাতি দেবতা ঠাকুরের রাগ-আক্রশ কে শেস করার জন্য দাঁশায় সংস্কৃতির আরম্ভ হয়। দুই - আরদের নারী দেবী কৌশলে অনার্যদের রাজা হুদুড় দুর্গা কে হত্যা করে, তার স্মরন করে।
তিন – কোন এক সময় অনার্য রমণী আয়ন, কাজল আরযদের দ্বারা অপহৃতের খোজে দেবি ও দুর্গা দুই যোদ্ধা বেরিয়ে আরজদের হাতে নিহত হয়, তাদের খোজে।
8. কারাম – কারাম (আশ্বিন-অগ্রায়ন), গ্রামের বা পরিবারের মধ্যে খরা থেকে রক্ষার জন্য। এখানের মূল মন্ত্র ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’।
9. নাওয়াই – নাওয়াই (ভাদ্র মাস) নতুন ফসল খাওয়ার পূর্বে দেবতাদের উদ্দ্যেশে উৎসর্গ করা হয়। তারপরে মানব জাতির ঐ নতুন ফশল খাওয়ার যোগ্য হয়।
10. জমসিম - জমসিম, আপদ-বিপদ অথা বাধা বিঘ্ন থেকে রক্ষা কারী উপাস্য সিঞ বঙ্গা পূজা অনুষ্ঠান। বিশেষ করে স্বগোত্রের মধ্যে হয়।কারিবাছি বা কুটাম ডাংরা, অন্য ধর্মান্তর থেকে মুক্ত থাকার জন্য।
11. আবগে বঙ্গা - আবগে বঙ্গা (অগ্রায়ন ও আষাঢ়), সাধারনত এই পুজা গৃহ দেবতা পূজা। এই পূজা পাঠের মাধমে বংশধর একই সূত্রতে বেঁধে থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমন থেকে রক্ষা পাই।
12. সাকরাত – এই উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়ীর সবাই একই সাথে ভোজন করে থাকে। পরিবারের যে কোন সদস্য বাইরে থাকলেও ঐ দিনে চলে আসে। তাছাড়া সাকরাত (পৌষ মাস) সমাজের বিশ্বাসঘাতক বা অপকর্ম কারীদের নাশ বা শিকারের লক্ষ্যে ইত্যাদি।
আদিবাসী সাঁওতালদের জন্মভুমি নিয়ে ‘জমসিম বিনতি’র এক বহু প্রাচীন লোক সঙ্গীত এ পাই -
“হিহিড়ি পিপিড়ি রেবন জানাম লেন
খোজকামান রেবন খোজ লেন
হারারাতা রেবন হারা লেন
সাসাং বেড়া রেবন জাতেনা হো।”
(হড় করেন মারে হাপড়াম ক রেয়াঃ কাথা - L.O.Skrefsruds, সাকাম -৩১)”
অর্থাৎ ‘হিহিড়ি পিপিড়ি’ নামক কোন এক পাহাড়ের উপত্যকায় তারা জন্মেছিল।‘খোজকামানে’ তারা জীবন জীবিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার অনুসন্ধান চালিয়েছিল।‘হারারাতা’ পাহাড়ে তারা বড় হয়ে উঠেছিল এবং সাসাং বেড়া নামক স্থানে গোত্র বিভাজন হয়েছিল। এই জায়গা তে বসবাসের সময় তারা নিজেদের কে আত্মরক্ষার জন্য গেলবার গটাং (১২ টা) গাড় (দুর্গ) তৈরি করেছিল।আরও জানা যায় এক সময় বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন কৌলিক বৃত্তি ছিল, সেগুলি হল –
1. হাঁসদা – কুটাম পুরি গাড়, ‘বিচারিয়া হড়’।
2. মুরমু – চাম্পাগাড়, ঠাকুর হড়।
3. সরেন – চায়বাহার গাড়, সিপাহি হড়।
4. কিস্কু – কঁয়ডা গাড়, রাজ হড়।
5. মানডি – বাদলি গাড়, কিসাড় হড়।
6. হেম্ব্রম – খায়রি গাড়, কুওয়ার হড়।
7. বাস্কে – লয়ং গাড়, বেপারি হড়।
8. টুডু – সিম গাড়, রুসিকা হড়।
9. বেস্রা –দুগ্ধা গার/বান্সারিয়া গাড়, নাচনিয়া হড়।
10. পাওরিয়া – বামা গার/পাওড়া গাড়, তান্তি হড়।
11. চঁড়ে – চিরু গাড়, মাহরা হড়।
12. বেদেয়া – হলংগাডা গাড়/রাহেড় গাড়, সিকারিয়া হড়।
বিনতি থেকে আমরা জানতে পারি একই গোত্র তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয় তার জন্য আদি পূর্বপুরুষ ‘পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুডহি’ তাদের সান্তান দের বারটি গোত্রতে বিভাজন করেছিলেন প্রথমে হিহিড়ি পিপিড়ি নামক স্থানে সাত টি পরে সাসাং বেড়া নামক স্থানে পাঁচটি। এ গুলি হল L.O.Skrefsruds এর লেখা থেকে পায় – “আঁদ পারিস লেকা উনকিন হাড়াম-বুডহি কিন পারিস কেদ কওয়া, মেতাঃ মে ; হাঁসদা, মুরমু, কিস্কু, হেম্ব্রম, মানডি, সরেন আর টুডু। উনকু এয়ায় সাবিক খুট ছাড়া আরহঁ ক মঁড়ে খুট কেদ-আ, মেতাঃ মে বাস্কে, বেস্রা, পাওরিয়া, চঁড়ে, আর মিদ পারিস ক আদ আকানা, উনকু-আ ঞুতুম দ বেদেয়া।” (হড় করেন মারে হাপড়াম ক রেয়াঃ কাথা - L.O.Skrefsruds, সাকাম -৩১) অর্থাৎ এ গুলি তাদের পদবি বলে গন্য হয়।
ধর্মবিশ্বাস ও দেব-দেবি : সাঁওতালদের পূজা পাঠের অন্য নাম ‘বঙ্গা বুরু’। সাধারনত সাঁওতালরা মূর্তি পুজায় বিশ্বাসী নন, অর্থাৎ সাঁওতাল সম্প্রদায় মূর্তি পুজা করেনা। তাঁরা প্রকৃতি পূজারী। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও পবিত্র স্থান হল ‘জাহের থান’। যেখানে সকল সাঁওতাল মানব গোষ্ঠীর পুজা পাঠের স্থান। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন পুজাস্থল থাকে যেমন হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিত, খ্রিস্টানদের চার্জ তেমনই সাঁওতালদের জাহের থান। আদিবাসীদের দেবস্থানে অর্থাৎ জাহের থানে বা জাহের খণ্ডে গাছ ও পাথরকে তার দেব-দেবীর আসনে বসিয়েছে । গাছ ও পাথরকেই আপাত দৃষ্টিতে দেবতা হিসাবে পূজা করে । আমরা যদি বহুল প্রচারিত শব্দ বস্তুবাদী দৃষ্টি ভঙ্গিতেও বিচার করে দেখি তবুও এই চিন্তা ভাবনার মধ্যেও যুক্তিবাদ আছে । আমরা জানি যে, গাছ ও পাথর এর হাত ধরেই মানব সভ্যতার শুরু । প্রথম যখন বনের জানোয়ার বিবর্তনের মাধ্যমে হাতিয়ার ছিল পাথর ।তারপর এই পাথর থেকেই আবিষ্কার হল লোহা আর এই লোহা দিয়েই তো এখন সভ্যতার তোড়পাড় । তারপর গাছ সে, তো আরও যুক্তি বাদী দেবতা একটা গাছ সমান দশটা প্রান, গাছ পালা ছাড়া জীব জগৎ প্রানী জগত বেঁচে থাকতে পারেনা। এই তথ্য বহু প্রাচীন যুগেই জানতে পেরেছিল গাছ ছাড়া মানব জীবন বাঁচা অসম্বব তাই তারা গাছ কে জীবন হিসাবে পাথার কে দেবতা হিসাবে পুজাপাঠ করে আসছে। পৌরাণিক কথা ‘জমসিম বিনতি’ থেকে জানা যায় সরগপুরি ‘চাওরিয়া মেলা’র কথা সেখানে দেবাতাদের সমাবেশ এ সভা হয়। সবচেয়ে বড় দেবতা হিসাবে ঠাকুর-ঠাকরান তাছাড়া লিটা অর্থাৎ মারাং বুরু, জাহের বুডহি ও ধরম।
এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য দেবতা হিসাবে মারাং বুরু, জাহের এরা, মঁড়েক তুরুয়ক, গঁসায় এরা, সিমা বঙ্গা ইত্যাদি। এসব দেব-দেবী ছাড়া প্রতি পরিবারে নিজস্ব অড়াঃ বঙ্গা (গৃহ দেবতা) ও আবগে বঙ্গা (পারিবারিক দেবতা) আছে।
সাঁওতাল তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমস্ত শাখার মানুষই প্রকৃতির পুজারি।আদিবাসিরা মূর্তি পূজা করেনা। যুগ যুগ ধরে তাঁরা গাছের তলায় পাথরের মাধ্যমে দেবদেবীর পূজা করা হয়। বৃক্ষ কে জীবন হিসাবে পাথর কে দেবতা হিসাবে গ্রহন করেছে।
তথ্যসুত্র ঃ
1. হেম্ব্রম, পরিমল – সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীতে সাঁওতালি ভাষা আন্দলনের ইতিহাস, পৃষ্ঠা – ৯
2. Godgil & Joshi, Madhav and N.V. - Peopling of India, pa – 4
3. টুডু, কৃষ্ণ চন্দ্র – সান্তাড়ী সাঁওহেদ রেনাঃ অমনম আর হারা, পৃষ্ঠা – ১৫৫।
4. গাগরাই, ডাঃ সরস্বতী – হো ভাষা কা বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন, পৃষ্ঠা – ২৭, ২৮
5. Hembram, Nityananda - Austric Civilization of India, pa – 21
6. Greierson G.A. - Linguistic Survey of India, Vol - IV, Munda and Dravidian Languages, p – 30
7. Greierson G.A. - Linguistic Survey of India, Vol-IV, Munda and Dravidian Languages, p – 30
8. স্ক্রেপস্রুড, এল ও – হড় করেন মারে হাপড়াম ক রেয়াঃ কাথা, পৃষ্ঠা -৩৬।
9. মাঝি, ডাঃ ধানেশ্বর –সান্থালি লোক কথা এক অধ্যয়ন, পৃষ্ঠা -১৫।
10. মুরমু ‘আদিবাসী’, বাবুলাল – আদ পারসি ঃ সান্থালি, পৃষ্ঠা – ৮০।
11. টুডু, ‘রাস্কা’, মাঝি রামদাস – খেরওয়াল বংশ ধরম পুঁথি (অনুবাদক – সুহৃদ কুমার ভৌমিক), পৃষ্ঠা - xxvi
12. Mukharjee, Charulal - The Santals, Page-154
0 Comments